Tuesday, July 26, 2011

স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল এফ আর খান

F. R.  Khan (Jr.)



ফটোগ্রাফার গোলাম বারী ইউনূসকে নিয়ে নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেলাম বনানীতে এবিসি লিমিটেডের করপোরেট অফিস-  এবিসি হাউসে। সাত তলায় বসেন তিনি। এক সময় নাটক সিনেমায় শহরের ভবন দেখাতে এবিসির এ ভবনটিকেই দেখানো হতো। তখনকার সময়ে এবিসি নির্মিত এ ভবনটিই ছিল কামাল আতার্তুক এভিনিউয়ের একমাত্র হাইরাইজ ভবন। এ ভবনের টপ ফ্লোরে স্ড়্গাইরম্নম রেস্টুরেন্ট বেশ জনপ্রিয়। লিফটে চড়লাম। এবিসি-র রিসেপশন থেকে গেস্টরম্নমে বসতে দেয়া হলো। কিছুড়্গণের মধ্যেই এলেন ঘরবাড়ী’র প্রধান সম্পাদক। ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কড়্গে দু-তিন জন অতিথি ছিলেন। গেট পর্যন্ত তাদেরকে এগিয়ে দিলেন তিনি। আন্তরিকতার পূর্ণ ব্যবহার। এবারে আমন্ত্রণ জানালেন আমাদের। মুখোমুখি বসলাম বিশ্বখ্যাত স্থপতি ফজলুর রহমান খানের ভ্রাতুষ্পুত্র এফ আর খানের (জুনিয়র) সামনে। চাচা ফজলুর রহমান খানের কথা আজও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এদেশের মানুষ। আন্তôর্জাতিক অঙ্গনে তার নাম এখনো উজ্জ্বল। তারই ভ্রাতুষ্পুত্র ফয়েজুর রহমান খান।
ফয়েজুর রহমান খান অর্থাৎ প্রকৌশলী এফ আর খানের জন্ম রাজধানী ঢাকাতেই। ১৯৫৫ সালের ২৯ মে। বাবা এম আর খান ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কন্ট্রোলার অব এক্সামিনেশন। মা কথাশিল্পী রাজিয়া মাহবুব। ১৯৭০ সালে সেন্ট্রাল গভ· হাই স্ড়্গুল থেকে এসএসসি উত্তীর্ণ হন। এরপর ’৭২-এ নটর ডেম কলেজ থেকে এইচএসসি। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৭-  বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, ঢাকা থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি। মাস্টার্স অব ইঞ্জিনিয়ারিং-   এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি। জাপান  থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন-এর ওপর পোস্ট মাস্টার্স সার্টিফিকেট কোর্স করেছেন ১৯৮১-১৯৮২ সালে। এছাড়া জাপান থেকেই ২০০৪ সালে টপ ম্যানেজমেন্ট কোর্স করেছেন তিনি।
এফ আর খানের কড়্গে মৃদুস্বরে বাজছিল রবীন্দ্রসঙ্গীত। সঙ্গীত পছন্দ করেন তিনি। আশ্চর্য হই। মানুষটি সম্পর্কে কি ধারণাই না করেছিলাম! বিভিন্ন অ্যাঙ্গেল থেকে ফটোগ্রাফার ইউনূস তার ক্যামেরা চালিয়ে যাচ্ছেন। আমরা ব্যস্তô আলাপচারিতায়।
একজন প্রকৌশলীর কাছে ভূমিকম্প বিষয়ক একটি প্রশ্ন না করলে যেন অপরিপূর্ণতা রয়ে যায়। সে ধারাবাহিকতায় ভূমিকম্প বিষয়ে জানতে চাওয়া। আশ্চর্য হই তার উত্তর শুনে! ভূমিকম্প বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ভূমিকম্প হচ্ছে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানুষ হিসেবে আমরা এটা রোধ করতে পারব না। আমি অন্ততপড়্গে এ বিষয়ে কোনো গ্যারান্টি দিই না। এটা সম্পূর্ণই সৃষ্টিকর্তার ইশারা। তবে আমার সুপারভিশনে যথাযথ বিল্ডিং কোড আর ভূমিকম্পবিষয়ক রীতিনীতি মেনে ভবন নির্মাণের চেষ্টা করি। এখানে কোনো গ্যাপ থাকে না।’ 
অন্যরা যেখানে ভূমিকম্প বিষয়ে নিজেদের নির্মাণকর্মের গুণগান গেয়ে চলেন, সেখানে এফ আর খানের এ ভাবনাই তাকে আলাদা করে রাখে, অন্যদের থেকে। সত্যিই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল তিনি।
কাজ পছন্দ করেন ফয়েজুর রহমান খান। রম্নচিসম্মত পেশাদারি মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলেন সামনের দিকে। প্রায় ৩৩ বছর ধরে নির্মাণ কাজে জড়িত। সুনামের সাথে কাজ করেছেন বহু প্রতিষ্ঠানে। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত দেশে-বিদেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন। দেশের সনামধন্য প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেডে যোগ দেন ১৯৮৫-তে। দু বছর কাজ করেন সেখানে। এরপর ’৮৮-’৯০ পর্যন্ত প্রাণ গ্রম্নপের প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডে। ১৯৯০ সালে যোগ দেন বিটিআই-তে। সেখানে ২০০৫ সাল পর্যন্ত। এরপর যোগ দেন অ্যাসেট ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড হোল্ডিং লিমিটেডে।

কর্মজীবনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কনস্ট্রাকশন কাজে নিষ্ঠার সাথে কাজে ডুবে থাকেন তিনি। এ পর্যন্ত নিজের সুভারভিশনে প্রায় ৫৫০০ ফ্ল্যাট সুনামের সাথে হস্তন্তর করেছেন গ্রাহকদের কাছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচয় ছাড়িয়ে নিজের একক ইমেজ তৈরি করে পরিচিতি লাভ করেছেন গ্রাহকদের কাছে। ফেসবুক-ফ্রেন্ডলিস্টে রয়েছে অসংখ্য ক্রেতার নাম।
গ্রাহকদের সাথে তার সম্পর্ক কেমন? তিনি জানান, ক্রেতাসাধারণের সাথে তার সম্পর্ক সুমধুর। কেননা, তাদের সন্তুষ্টিই তার প্রাপ্তি। প্রায়ই ফোন পান ক্রেতাদের কাছ থেকে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, অনেক সময় চিনতেই পারেন না কোন প্রজেক্টের কোন ক্রেতার ফোন। অথচ আশ্চর্যের ব্যাপার, অনেক পুরনো ক্রেতারা আজও ফোন করে তাকে শুভেচ্ছা জানান, ভালোবাসা জানান। এটাকেই তার বড় অর্জন বলে মনে করেন তিনি। আর এটা তাকে অর্জন করতে হয়েছে কাজের মধ্যদিয়ে। তার সুপারভিশনে নির্মিত প্রতিটি প্রজেক্ট উদ্বোধনে উপস্থিত থাকার চেষ্টা করেন তিনি। এছাড়া হস্তôান্তôরকৃত প্রতিটি প্রজেক্টে দু-তিন মাস পর্যন্ত খোঁজ নেয়াটা নিজের দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। ফলে ক্রেতাগণও তাকে ভুলতে পারেন না।
কফি এলো আমাদের জন্য। কফিতে চুমুক দিতে দিতে আলাপচারিতা এগিয়ে যায়।
হেরিটেজের গুরম্নত্ব দিয়ে তিনি বলেন, বর্তমানের ভবনগুলোর মধ্যে হেরিটেজ অনুপস্থিত। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, স্পেনেও হেরিটেজের ছোঁয়া বজায় রেখে ভবনের কথা উলেস্নখ করে তিনি বলেন, বাইরে হেরিটেজের ছোঁয়া রেখে ভেতরে আধুনিক সুযোগসুবিধা সম্বলিত ভবন তৈরি করা যেতে পারে।
বর্তমানের আবাসন খাতের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয় উলেস্নখ করে তিনি বলেন, এ সেক্টরে রাজধানীর গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির ওপর থেকে ফোকাস বন্ধ করতে হবে আগে। সর্বোপরি রাজধানীর ওপর থেকে ফোকাস বন্ধ করে রাজধানীর বাইরেও এ শিল্পকে চাঙ্গা করতে হবে।
ইউনূস যেন তার মনের মতো ছবি পাচ্ছিলেন না। ক্যামেরা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তখনও। রবীন্দ্রসঙ্গীত শেষ হয়ে সুমনের গান ভেসে আসছে মিউজিক পেস্নয়ার থেকে।
চাচা ফজলুর রহমান খানের সাথে মিল-অমিলের কথা জানতে চাইলে তিনি জানান, চাচার সাথে তার মিলটাই বেশি। দুজনের জীবনের চিন্তôাধারা, পারিবারিক সম্পর্ক আর সংস্ড়্গৃতিচর্চা একই। জীবনকে উপভোগ করতে ভালোবাসতেন চাচা। তার মধ্যেও সে বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তবে অমিলের কথায় তিনি জানান, চাচা যতটা বাস্তôববাদী ছিলেন ততটা তিনি নন। তিনি চাচার চেয়ে একটু বেশি আবেগী। 





F. R.  Khan (Jr.)






বর্তমানে এবিসি’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক

 
২০১০ সালের নভেম্বরে এবিসি পরিবারে যুক্ত হন এফ আর খান। ১৯৭২ সালে এবিসি লিমিটেডের যাত্রা শুরম্ন। মূলত কনস্ট্রাকশন প্রতিষ্ঠান হলেও এর ব্যাপকতা আরো ছড়িয়ে পড়ে ভিন্ন আমেজে। ১৯৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবিসি রিয়েল এস্টেট লিমিটেড। ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠান হিসেবে তুলনামূলকভাবে পাবলিক সেক্টরে খুব বেশি কাজ করেনি এবিসি।
প্রাইভেট সেক্টরে তাদের কার্যক্রম বেশ উজ্জ্বল। নীতিগত আদর্শের কারণেই এবিসি পাবলিক
সেক্টরে ব্যাপক বিস্তôার লাভ করেনি। তবে হস্তôান্তôরকৃত তাদের বিভিন্ন প্রজেক্টগুলো কিন্তু দাবি রাখে, এদেশের নির্মাণজগতে এবিসি-র পথচলা হোক আরো সুদূরপ্রসারী।  সে দাবিকে আরো সোচ্চার করে বাস্তôবে রূপ দিতেই যেন জনাব এফ আর খান যোগ দিলেন এবিসিতে।
মানসম্মত ভবন নির্মাণে এবিসি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ক্রেতা সন্তুষ্টির দিকে নজর রাখা হয় সচেতনভাবেই। এবিসি নির্মিত বিভিন্ন ভবনের মধ্যে এবিসি হেরিটেজ, এসএমসি টাওয়ার, গ্রামীণফোন ভবন, জীবন বীমা ভবন, ন্যাম অ্যাপার্টমেন্ট ভবন, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি বিল্ডিং উলেস্নখযোগ্য। এছাড়া বিএসআরএম স্টিল মিল, সিমেক্স সিমেন্ট ফ্যাক্টরি, পিএইচপি’সহ অসংখ্য ফ্যাক্টরি ভবন নির্মাণের সফল এবিসি। সুনামের সাথে বহু ফ্ল্যাটের হস্তôান্তôর এবিসি-র সুনামকে আরো বৃদ্ধি করেছে। বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডি, গুলশান, বারিধারা, শ্যামলী, মিরপুরে বহু অ্যাপার্টমেন্ট হস্তôান্তôর করেছে তারা। বর্তমানে হাতে রয়েছে বেশ কিছু প্রজেক্ট। এর মধ্যে বসুন্ধরা, গুলশান, বনানী, ইস্ড়্গাটন ও উত্তরায় রয়েছে বেশ কিছু প্রজেক্ট। নতুন করে এফ আর খানের ব্যবস্থাপনায় আবাসন খাতে এবিসির কার্যক্রমকে ছড়িয়ে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।  
 



দুই ব্র্যান্ডের মিলন যেন! 

 
একজন এফ আর খান, অন্যটি এবিসি-  দুটি ব্র্যান্ডই পরিচিত এদেশের নির্মাণ জগতে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে এবিসি ও এর আবাসন খাতের কার্যক্রমকে আরো এগিয়ে নিতে এফ আর খানের চিন্তôাধারা এরই মধ্যে এগিয়ে যেতে শুরম্ন করেছে। ছক করে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। অফিসে চলছে নতুন ডেকোরেশনের কাজ। এরই মধ্যে এবিসির ব্যানারে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন প্রজেক্ট। একটু বড় প্রজেক্টের দিকেই তাদের লড়্গ্য। প্রকৌশলী এফ আর খানের ছোঁয়া আর এবিসি-র কনস্ট্রাকশন কাজের সুনাম একাকার হয়ে এ শিল্পে ভালো কিছু আশা করতেই পারে ক্রেতাসাধারণ।
আলাপচারিতা তখন শেষের পর্যায়ে। এবিসি নিয়ে তার কার্যক্রম জানতে চাই।
আবাসন খাতে এবিসির কার্যক্রমকে নতুন আঙ্গিকে ঢেলে সাজাতে চান এফ আর খান। এবিসির ভবিষ্যৎ প্রজেক্টগুলোকেও ব্র্যান্ড হিসেবে পরিচিতি করাতে তার চেষ্টা অব্যাহত থাকছে। আর এড়্গেত্রেও তিনি সফলতার স্বাড়্গর রাখবেন- প্রত্যাশা এমনই।
এফ আর খান চাচা ফজলুর রহমান খানের ছায়া যেন! পেশাদার প্রকৌশলী ও পরিকল্পনাবিদ। আস্থা রাখা যায় অনায়াসেই। আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজের কাজ করে যান নীরবে। অবশ্য সেসব কাজের প্রতিফলন একসময় আর নীরব থাকে না। নিজের কাজ নিয়ে বাগাড়ম্বর ভাব নেই। অহংকার নেই কিন্তু কাজে আছে সফলতা। আর এসব কারণেই তিনি এফ আর খান-  অন্যদের থেকে আলাদা।
স্বনামধন্য একজন প্রকৌশলী ও রিয়েল এস্টেট ডেভলপার হিসেবেই নয়, মানুষ হিসেবেও চমৎকার বিনয়ী এই ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হতে পেরে ভালো লাগল।
ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে পড়ি রাজধানীর রাস্তôায়।

No comments:

Post a Comment